ঢাকা রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ 

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর গদ্যশৈলী

প্রকাশিত: ১৬:৫১, ৩১ আগস্ট ২০২৩

শেয়ার

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর গদ্যশৈলী

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ধারার প্রবন্ধের প্রকাশভঙ্গির ক্ষেত্রে কতগুলো লক্ষণ স্পষ্ট। বিপুলসংখ্যক লেখাই দুর্বোধ্য, অস্পষ্ট, নিরস, কুহকী এবং অলংকারবর্জিত অসুন্দর গদ্যে তৈরি। কারও কারও গদ্যরীতিটি আক্রমণাত্মক। এর ফলে গদ্য হয়ে পড়েছে সৌন্দর্যহীন, কর্কশ এবং স্থূল।

দু-একজনের গদ্যরীতি মিষ্টি কথায় আক্রান্ত বা পাণ্ডিত্যের ভারে গম্ভীর থাকায় পাঠকের জন্য পঠন-পাঠনে দূরতিক্রম্য। এমন বহু রচনাই পাওয়া যায়, সে সবের রচয়িতাদের উদ্দেশ্যে মহৎ। কিন্তু নিজেদের অভ্যাস হেতু রচনা হয়ে ওঠে উদাসীন গদ্য বা ক্লান্ত গদ্যের রূপ। বিষয় ভাবনা অপূর্ব হওয়া সত্ত্বেও বহু রচনার গদ্যের রূপরীতি কুয়াশাচ্ছন্ন ভাববাদ প্রচারের গদ্যরীতিতে আক্রান্ত। এর ফল দাঁড়ায় এই যে, পাঠক শ্রেণি বুঝতে পারেন না প্রবন্ধকার কী বলতে চাচ্ছেন।

বামপন্থি রাজনীতিতে বিশ্বাসী হয়েও ব্যক্তিবাদের অহংবোধ আক্রান্ত গদ্যরীতির প্রয়োগ অনেক ক্ষেত্রে পাঠককে লেখক থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেয়। রাজনীতি তথা প্রগতিবাদের কথা বলতে গিয়ে চাতুর্যপূর্ণ বাকভঙ্গি প্রয়োগ করে বাংলাদেশে কেউ কেউ তরুণ পাঠক শ্রেণিকে বিভ্রান্ত করে চলেছেন। এই যে চারপাশে নানা রকম প্রতিবন্ধকতা সেসব অত্যন্ত সচেতনতার সঙ্গেই অতিক্রম করতে পেরেছেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
আমার পক্ষে তার সম্পর্কে লেখা অনেকটা দুঃসাধ্য। কেননা তার সাহিত্য চিন্তা, সমাজচিন্তা এমনকি ব্যক্তিগত প্রবন্ধ থেকেও রাজনীতিকে আলাদা করা প্রায় অসম্ভব। ভাষা যে জীবনবিচ্ছিন্ন নয়, রাজনীতি নিরপেক্ষ নয়, তা টের পাওয়া যায় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রবন্ধ পাঠ করলে। আর এই যে রাজনীতির জীবন কথক, তার গদ্যরীতিটিও একেবারেই আলাদা এবং নিজস্ব। কথাসাহিত্যের ভুবনে তার বিচরণের অভিজ্ঞতা রয়েছে বলেই অথবা দীর্ঘদিনের গদ্যচর্চার ফলে নিজের জন্য আলাদা একটি গদ্যের ভুবন বা রূপরীতি তিনি আবিষ্কার করে নিয়েছেন গদ্যটি তার পরিপাটি বলেই জটিলতামুক্ত। জটিল শব্দ চয়ন বা বাক্য বন্ধন তার স্বভাবে নেই।

ইংরেজি সাহিত্যের মেধাবী অধ্যাপক হিসাবে তার গদ্যে ইংরেজি শব্দ ব্যবহারের আশঙ্কা ছিল কিন্তু তা ঘটেনি। এমনকি প্রচলিত তৎসম শব্দের বহুল ব্যবহার এবং সংস্কৃত প্রত্যয় বা ধাতুজাত শব্দও তিনি যথাসম্ভব পরিহার করেছেন। ব্যাকরণের শব্দতত্ত্ব ও রূপতত্ত্ব সম্পর্কে তার সচেতনতা অবাক করার বিষয়। কেননা তিনি বাংলাভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন না।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী জানেন তার লেখালেখির উদ্দেশ্য পাঠকের স্নায়ুতে মাদক রস কিংবা আমোদ-প্রমোদ রস প্রবেশ করানো নয়, পাঠকের চিন্তার অনুশীলন দ্বারা সামাজিক সত্যের সামনে দাঁড় করানো। আমার মনে হয় সামাজিক সেই সত্যকে জনগণের মধ্যে জাগিয়ে তোলার উদ্দেশ্যেই তিনি সাহিত্য জীবনের শুরুতে কথাসাহিত্যের নির্মাণ কাজে হাত দিয়েও সরে আসেন প্রবন্ধ সাহিত্যে। কারণ, তার চোখের সামনে তখন পঞ্চাশের আর ষাটের দশক।

এ দেশের মানুষের মুক্তি প্রত্যাশা প্রকাশের পরিপক্ব কাল। এমনি কালে তৃণমূল মানুষ ও নতুন তৈরি হতে থাকা দুর্বল মধ্যবিত্তের জন্য রাজনীতির সঠিক পথের আবশ্যকতাই ছিল জরুরি, কবিতা কিংবা গল্পের চেয়ে। আর সেই পথটা হলো সমাজব্যাখ্যা। সেই উদ্দেশ্য থেকেই বুদ্ধিদীপ্ত প্রতিভ, পরিশীলিত রুচি এবং ধারালো যুক্তিকে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার শিল্প নির্মাণের উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করেন।
একটু মনোযোগ দিয়ে পাঠক যদি তার রচনা পাঠ করেন তবেই লেখকের শিল্প কৌশলটি ধরতে পারবেন। ‘তাজউদ্দীন আহমদের অবস্থান’, জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক ভূমিকা’, ‘শেখ মুজিবের অঙ্গীকার’, ‘বিদ্যাসাগরের কাজ’ ‘আমার পিতার মুখ’ ইত্যাদি প্রবন্ধ তার দৃষ্টান্ত।

যে কোনো লেখাই (প্রবন্ধ) যখন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লিখতে বসেন তখন তার গদ্য রূপটি হয়ে ওঠে একের ভেতর বহুর রূপ। কখনো গল্পের প্রতীকী ব্যঞ্জনায় কিংবা কখনো কবিতার শব্দ ও ছন্দের অনিবার্য বিন্যাসে সমাজের স্বপ্ন ও আগামী কল্পনার রূপকে নিজের করে নিয়ে তিনি পাঠকের সামনে তুলে ধরেন।

তার রচনায় ‘উত্তম পুরুষ’ রীতিতে বলা গদ্য এবং ‘সর্বজ্ঞ লেখকের দৃষ্টিকোণ’ থেকে বলা গদ্যগুলো পাঠ করলে বোঝা যায়, গদ্যরীতিটি সুনির্দিষ্ট বিষয়ের জন্যই উপযুক্ত। তাই মনোযোগী এবং কৌতূহলী পাঠক ভুলে যান তিনি গদ্য কবিতা নাকি গল্প নয়তো প্রবন্ধ পাঠ করছেন। প্রবন্ধের গঠনরীতিটি যে মন্ময় বা তন্ময় উপবিভাগ রয়েছে, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর গদ্যের ভেতর তা মিলেমিশে একাকার হয়ে সম্পূর্ণ আলাদা রীতিতে পরিণত হয়। সেই গদ্যরীতিটিই তার নিজস্ব কণ্ঠস্বর। তার এ গদ্যশৈলীর পেছনে কাজ করে নিজস্ব গভীর শ্রেণিজ্ঞান বা শ্রেণি চেতনা। সেই জ্ঞানে ঋদ্ধ বলেই তিনি মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে উঠে আসা পাঠক শ্রেণি এবং সাধারণ মানুষের বোধ বা অনুভবের ভাষাকে বুঝতে পারেন। ঠিক এমন জনগণের অনুভবের ভাষাকে বুঝতে পারতেন দুই বিপরীত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মওলানা ভাসানী এবং শেখ মুজিবুর রহমান।

novelonlite28
umchltd