ঢাকা রোববার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪ 

গুলশানে সাবেক এমপি-মন্ত্রীর কবজায় ২০০ কোটির বাড়ি

মো: মাজহারুল পারভেজ

প্রকাশিত: ১৫:৫৮, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪

শেয়ার

গুলশানে সাবেক এমপি-মন্ত্রীর কবজায় ২০০ কোটির বাড়ি
সাবেক এমপি শফি উদ্দিন শামীম

রাজধানীর অভিজাত গুলশান এলাকায় এমপি-মন্ত্রী চক্রের হাতে পড়েছে ২০০ কোটির এক বাড়ি। দখল আর পাল্টা দখলের মধ্যে পড়ে থাকা এই বাড়িটি ৫০ নম্বর সড়কের ৫ নম্বর প্লট। প্রায় ১১ বছর ধরে আওয়ামীলীগের সাবেক এক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য মিলে দখলে রেখেছেন বাড়িটি। 

বাড়িটি যাতে হাতছাড়া না হয় এজন্য তারা এখন নাম ভাঙ্গাছেন এক বিএনপি নেতার। কিছুদিন আগেও বাড়ির বাসিন্দারা বাড়িটি সাবেক গণপূর্তমন্ত্রী র. আ. ম. উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর বলে জানিয়েছেন। তবে বাড়ির প্রধান ফটকে সাটানো এসকিউ গ্রুপের সাইনবোর্ডটি এখন আর নেই। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাতারাতি বাড়ির প্রধান ফটক থেকে ওই সাইনবোর্ড সরিয়ে ফেলা হয়। এরপর এই বাড়ি নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে রহস্য আরও দানা বাঁধতে শুরু করে।

সরেজমিনে দেখা যায়, বাড়িটির পূর্ব পাশে অভিজাত গুলশান ক্লাব। পশ্চিম পাশে গুলশান লেক। মাঝখানে ছায়া নিবিড় মনোরম পরিবেশে লেকের কোল ঘেঁষে এই বাড়ি। ২০ কাঠার দ্বিতল ভবনের এই বাড়ির মূল্য প্রায় ২০০ কোটি টাকা বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা এই প্রতিবেদককে জানান, গত এক বছর ধরে পরিত্যক্ত এই বাড়িতে সদ্য সাবেক গণপূর্তমন্ত্রী  র. আ. ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপির লোকজন বসবাস করতো। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অফিসে গিয়েও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। রাজউকে ‘এ ফাইল নেই’ বলে জানালেও পরে অবশ্য রেকর্ডরুমেই ফাইলটি পাওয়া যায়। ফাইলের উপরে সাবেক গণপূর্তমন্ত্রী  র. আ. ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর ভিজিটিং কার্ড স্ট্যাপলিং করা। আওয়ামী সরকারের প্রভাবশালী এই মন্ত্রীর নির্দেশে পুরোনো তারিখে জাল নথিপত্র তৈরি করে পরিত্যক্ত থেকে অবমুক্ত করা হয়। অবমুক্ত হওয়ার পর রাতারতি গেজেটও হয়ে যায়। এখন শুধু অডিট আপত্তি নিস্পত্তির অপেক্ষায়। তবে গেজেট নিয়েই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন রাজউকের দায়িত্বপ্রাপ্ত একাধিক কর্মকর্তা। তাদের ভাষ্য, এ গেজেট প্রকাশ নিয়ে কোনো তথ্য তারা জানেন না। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্টেটের -১ এর এক কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে জানান, পরিত্যক্ত বাড়ির ফাইল আমাদের এখানে থাকার কথা না। এই ফাইল গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে থাকার কথা। তবে এ ফাইল রাজউকের রেকর্ড রুমে কী করে এলো তা নিয়ে কেউ মুখ খুলতে চাচ্ছেন না।
 
স্টেট-১  এর সদ্যবিদায়ী পরিচালক কামরুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাড়িটি পরিত্যক্ত। পরিত্যাক্ত বাড়ির ফাইল সাধারণত মন্ত্রণালয়েই থাকে। এছাড়া ফাইলের উপরে সাবেক মন্ত্রীর ভিজিটিং কার্ড কেন রাখা হয়েছে এ বিষয়ে আমার জানা নেই।’

রাজউকের রেকর্ড রুম থেকে উদ্ধার হওয়া এই ফাইল ঘেঁটে জানা যায়, গুলশান আবাসিক এলাকায় লেকের কোল ঘেঁষে এমডব্লিউ (কে) ব্লকের ৫০ নম্বর রাস্তার ৫ নম্বর প্লটটির  জমির পরিমাণ প্রায় ১৯ কাঠা ৬ ছটাক। ১৯৬০ সালে পাওয়ার ওয়াপদার ঢাকার তৎকালীন কমিশনার মৃত নুর মোহাম্মদের ছেলে মি: এ এন মোহাম্মদ এর নামে বরাদ্ধ দেওয়া হয়। ৫ বছর পর ১৯৬৫ সালে একই ব্যক্তির নামে আবার লিজ ইস্যু করা হয়। ১৯৭২ সালের জুনের ৩ তারিখে লিজকৃত এই জমি ১৬/সি আরামবাগ, রমনা, ঢাকার জনৈক আব্দুল আলী সরকারের ছেলে মি: খলিলুর রহমানের কাছে হস্তান্তর করা হয়। 

১৯৭৪ সালে আবারও এই প্লট হাতবদল হয়। ২, নয়াপল্টন ঢাকা এলাকার জনৈক মৌলভী ফয়েজ উদ্দিন আহমেদের মেয়ে মিসেস মাহমুদা বেগমের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ১৯৮৪ সালে মাহমুদা বেগম তার নাতি সাদেকুর রহমানকে উক্ত প্লট দান করে দেন। সাদেকুর রহমানের ঠিকানা দেখানো হয়েছে বাড়ি নং ১৭, রোড নং ২৩, ব্লক- বি, বনানী।  তিনি দানের এই সম্পত্তি  ২০০৯ সালের ২৬ মে বিল্ডিং ড্রিমস নামে এক প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে দেন। 

বিল্ডিং ড্রিমস-এর স্বত্তাধিকারী দেখানো হয়েছে বনানীর ব্লক এইচ-এর ৭ নং রোডের ৩৬ নং বাড়ির রাজেশ শেঠীকে। উক্ত ঠিকানায় সরেজমিনে পরিদর্শন করে এই বাড়িতে রাজেশ শেঠী নামে কোনো ব্যক্তিকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। দুতলা এই বাড়িতে কেউ বসবাস করে না। পুরোটা জুড়েই ও’প্লে ইটালিয়ান বিসট্র নামে একটি রেস্তোরা।

রেস্তোরার ম্যানেজার আব্দুল মোকাব্বর কাইয়ুম এই প্রতিবেদককে জানান, গত দুই বছর ধরে এই রোস্তোরা এখানে ব্যবসা করছে। তারা আসার আগে এই বাড়ি একটি সেলুন ছিল।  বাড়ির মালিকের নাম ইশতিয়াক হোসেন।

২০০৯ সালের ২৭ মে "বিল্ডিং ড্রিমস লিমিটেড" এর পক্ষে ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাজেশ শেঠী নামজারির জন্য রাজউকে আবেদন করেন। তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এবং হস্তান্তর দলিল নং-৩৬৪২, তারিখ ১০/০৫/০৯ ইং এর আলোকে কোনো তথ্য গোপন না করার শর্তে  নামজারি দেওয়া হয়। তবে কোনো কারণে ভবিষ্যতে আইনি জটিলতার/ মামলার উদ্ভব হলে তার দায়-দায়িত্ব রাজেশ শেঠীর উপর বর্তাবে বলে শর্ত জুড়ে দেয় রাজউক।
রাজেশ শেঠী আবার তা হস্তান্তর করে হাছবিনা মাহবুবের কাছে। হাছবিনা মাহবুব তার ঠিকানা দেখিয়েছেন গুলশানের ৫০ নম্বর সড়কের পরিত্যক্ত এই ৫ নং প্লট। এই ঠিকানায় তাকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

১৯৯৬ সালে ১৬২টি প্লটের সাথে এই প্লটটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়য়ক বিভাগ পরিত্যক্ত সম্পত্তি  ১৯৮৬ ( এস আরও নং -৩৬৪),৬৫ ও ২৮৮ নং বহিতে  ”খ” তালিকার ১০ নং সিরিয়ালে  উল্লেখ রয়েছে। 

বিতর্কিত এই বাড়ির নিরাপত্তা প্রহরী মিজানুর রহমান বলেন, ‘বাড়িটি এমপি শফি উদ্দিন শামীম স্যারের।’ কীভাবে এমপি শামীম মালিক হলেন জানতে চাইলে বাড়ির প্রধান ফটকে সাটানো এস কিউ ট্রেডিং এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম মেশিনারিজ ডিভিশনের একটি সাইনবোর্ড খুলতে খুলতে নিরাপত্তা প্রহরী বলেন, ‘এ বিষয়ে এর চেয়ে বেশি কিছু আমি জানি না।’ 

এস কিউ ট্রেডিং এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মের মালিক শফি উদ্দিন শামীম। সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংকের সাবেক এই চেয়ারম্যান ও সাবেক এই এমপির বিরুদ্ধে নানা লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে।

তড়িঘড়ি করে কেন সাইনবোর্ডটি খুলে ফেলা হচ্ছে জানতে চাইলে নিরাপত্তা প্রহরী বলেন, ‘দোতলায় স্যারেরা আছেন, তাদের সাথে কথা বলেন।’ এরপর উপরে গিয়ে এস কিউ গ্রুপের ট্রান্সপোর্ট বিভাগের প্রধান সৈয়দ মেহরাব আলীর কাছে এই বাড়ির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ সম্পত্তি এস কিউ গ্রুপের।’ তবে এস কিউ গ্রুপ কীভাবে এই সম্পত্তির মালিক হয়েছে, এ সংক্রান্ত কোনো কাগজপত্র দেখাতে অস্বীকার করেন তিনি।

novelonlite28
umchltd