দক্ষিণ আফ্রিকায় পাকিস্তানি মানব পাচার চক্রের দাপট বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে মোজাম্বিক ও ইসোয়াতিনিতে বেআইনিভাবে বসবাসকারী পাকিস্তানি অপরাধীদের দৌরাত্মে অতিষ্ঠ সেখানকার মানুষ। বেআইনি অনুপ্রবেশকারী পাকিস্তানিদের সংখ্যা গত কয়েক বছরে অনেকটাই বেড়ে গেছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রকাশ্যে ছোটখাটো ব্যবসা করলেও আসলে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ চক্রের সঙ্গে যুক্ত পাকিস্তানিরা। মোজাম্বিক ও ইসোয়াতিনি প্রদেশের উন্মুক্ত সীমান্ত তাদের আরও বেশি করে উৎসাহিত করে তুলেছে। সেখানে সীমান্তে পাহাড়ার বালাই নেই। সেই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে দিন দিন বেড়েই চলেছে অনুপ্রবেশ। অনুপ্রবেশকারীরা বেশিরভাগই পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের বাসিন্দা। মানবপাচারকারীদের হাত ধরে তারা এখন দক্ষিণ আফ্রিকায় বেআইনিভাবে বসবাস করে বিভিন্ন অপরাধ চক্রে যুক্ত রয়েছে।
মোটা অঙ্কের অর্থের লোভে পাকিস্তানি মানবপাচার চক্র দক্ষিণ আফ্রিকাকে তাদের অপরাধের জাল বিস্তারের জন্য বেছে নিয়েছে। আর তাদের এই মানবপাচার চক্রের জাল বিস্তারে সক্রিয়ভাবে মদদ জুগিয়ে চলেছে 'পাকিস্তান দক্ষিণ আফ্রিকা অ্যাসোসিয়েশন' বা পিএসএএ। প্রকাশ্যে এই সংস্থাটি অনেক ধরনের সামাজিক কর্মকাণ্ডের কথা বললেও আসলে তাদের কাজ মানবপাচারকারীদের কাজের সুবিধা করে দেওয়া। দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে বন্ধুত্বের কথা বলে আসলে সেখানকার মানুষদের সর্বনাশ করে চলেছে এই সংস্থাটি। দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প করে তারা মানবপাচারকারীদের কাগজপত্র তৈরি করে দেওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্নভাবে সহায়তা করছে। সেখানে চাকরির টোপ দেওয়া থেকে শুরু করে নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছেন পিএসএএর কর্মকর্তারা। তাদের সক্রিয়তাতেই ফুলে-ফেঁপে উঠছে মানব পাচারচক্র। কেউ ধরা পড়লে তাকে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ছাড়ানোর বিষয়েও এই সংস্থাটির সক্রিয়তা সকলেই জানেন।
দক্ষিণ আফ্রিকায় পিএসএএর নেটওয়ার্ক সর্বত্রই ছড়ানো। সেই নেটওয়ার্ক থেকেও অপরাধীদের সবধরনের সহায়তা দেওয়া হয়। তাই অবাধে পাকিস্তানি মানবপাচারকারীরা তাদের জাল বিস্তার করতে সক্ষম হচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকায়। গোটা দক্ষিণ আফ্রিকা জুড়েই পাকিস্তানি অপরাধ চক্রের রমরমা কারবার চলছে। ছেয়ে গেছে বেআইনি অনুপ্রবেশকারীদের দোকানে। তবে অপেক্ষাকৃত ধনী প্রদেশ গাউটেং, লিম্পোপো, ইস্টার্ন কেপ ও কোয়াজুলু-নাটাল প্রদেশে পাকিস্তানিদের আধিপত্য বেশি। এই প্রদেশগুলোতেই বেশি সক্রিয় পাকিস্তানি অনুপ্রবেশকারীরা। যেহেতু এই প্রদেশগুলোর আর্থিক অবস্থা কিছুটা হলেও ভালো, তাই পিএসএএও এই প্রদেশগুলোতে একটু বেশিই সক্রিয়।
বেআইনি অনুপ্রবেশকারীরা দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রবেশের পর প্রথমে কাজ পান পাকিস্তানি মালিকানাধীন বিভিন্ন দোকানে। সাধারণ দোকান, শপিংমল, সেলুন বা মোবাইলের সার্ভিস সেন্টারে কাজ নিয়ে তারা সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। হাওলা কারবারিরাও এইসব বেআইনি অনুপ্রবেশকারীদের ছোটখাটো শহরে বা গ্রামাঞ্চলে ব্যবসা করার জন্য আর্থিক সহায়তা দেয়। পাকিস্তানি হাওলা কারবারীরাও দক্ষিণ আফ্রিকায় বেশ সক্রিয়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেই চক্রটি কাজ করে। নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থেই তারা স্থানীয়দের সঙ্গে মিলেমিশে থাকার চেষ্টা করে এসেছেন এতোকাল। অনেকেই ভালো ব্যবহারের মাধ্যমে স্থানীয়দের সঙ্গে সখ্যতাও গড়ে তুলেছিলেন। সেইসঙ্গে নিজেদের বেআইনি কারবার আড়াল করতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়মিত ঘুষ দেওয়াটাকেও তারা রপ্ত করে নিয়েছিলেন। ফলে এতোদিন ছোটখোটা ব্যবসা করে দিন গুজরানে কোনও অসুবিধাই হয়নি পাকিস্তানি অনুপ্রবেশকারীদের।
কিন্তু স্থানীয়দের থেকে এখন শুরু হয়েছে প্রতিবাদ। তারা বুঝতে পেরেছেন, বেআইনি অনুপ্রবেশকারীরা স্থানীয় অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। দিন দিন ব্যাঙের ছাতার মতো পাকিস্তানি অনুপ্রবেশকারীদের দোকান গজিয়ে ওঠার বিরুদ্ধে তাই স্থানীয়রা শুরু করেছেন প্রতিবাদ। সম্প্রতি গাউটেং প্রদেশের সোয়েটো শহরে এক পাকিস্তানির দোকান থেকে কেনা খাবারে কয়েকটি শিশুর মৃত্যুর পর স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ মারাত্মক বেড়ে যায়।
পাকিস্তানিদের দোকান ভাঙচুর ও লুটপাটও হয় সেখানে। পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে স্থানীয়রা বিভিন্ন সরকারি অফিসের সামনে বিক্ষোভ দেখান। তাদের অভিযোগ, সরকারই মদদ জোগাচ্ছে পাকিস্তানের বেআইনি অনুপ্রবেশকারীদের। এর ফলে স্থানীয়রা কর্মসংস্থান থেক বঞ্চিত হচ্ছেন। বাড়ছে অপরাধের সংখ্যাও। বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে ক্ষোভের আগুন। ইস্টার্ন কেপ ও কোয়াজুলু-নাটাল প্রদেশেও একই ধরনের বিক্ষোভ দেখা দেয়। বিক্ষোভের কারণে প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা বিবৃতি দিতে বাধ্য হন। ১৬ নভেম্বর তিনি এক বিবৃতিতে জানান, বেআইনি দোকানদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে সরকার। তবে তিনি কোনও জাতি বা দেশের নাম করেননি। পাকিস্তানের নাম উহ্য রেখেই দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট বিবৃতি দেওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ আরও বেড়ে গেছে। তারা কিছুতেই পাকিস্তানি অনুপ্রবেশকারীদের দোকান চালাতে দিতে নারাজ। তাদের অভিযোগ, দোকান চালানোর নামে নানাধরনের অবৈধ কাজকর্মের সঙ্গেও যুক্ত পাকিস্তানিরা। নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থেই তারা চান, এলাকাকে বেআইনি অনুপ্রবেশ মুক্ত রাখতে। তাই চলছে বিক্ষোভ।
পরিস্থিতি জটিল দেখে ১৭ নভেম্বর বিভিন্ন পাকিস্তানি সংগঠনের কর্মকর্তারা জোহেনসবার্গে বৈঠকে বসেন। পাকিস্তান দক্ষিণ আফ্রিকা অ্যাসোসিয়েশন ছাড়াও পাকিস্তান ইউনিটি ফোরামের নেতারাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ইসলামিক সার্কেল সাউথ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়। স্থানীয়দের উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রশমনে আপাতত ধীরে চলো নীতি নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। সেইসঙ্গে কোটি কোটি টাকার মানবপাচারের ব্যবসা আগামী দিনে কীভাবে দক্ষিণ আফ্রিকাতে করা যায় তা নিয়েও তারা চিন্তাভাবনা শুরু করে দিয়েছেন। স্থানীয় বিভিন্ন জনজাতির প্রতিনিধিদের বোঝানোর চেষ্টাও চলছে। তবে স্থানীয়রা কিছুতেই পাকিস্তানি ফাঁদে পা দিতে নারাজ।
স্থানীয় মুসলিমরাও এখন পাকিস্তানি অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে সরব। তারাও বুঝতে পারছেন, বেআইনি অনুপ্রবেশকারীদের জন্য স্থানীয় মুসলিমরাও বিপাকে পড়ছেন। তাদের অর্থনীতিতে থাবা বসাচ্ছে পাকিস্তান। তাই সরকারের কাছে তারাও দাবি তুলেছেন, বেআইনি অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে। স্থানীয়দের কর্মসংস্থানের স্বার্থেই দক্ষিণ আফ্রিকায় বিপাকে পাকিস্তানিরা। অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে সেখানে দিন দিন বিক্ষোভ বাড়ছে। স্থানীয় বিভিন্ন জনজাতির সঙ্গে মুসলিমরাও পাকিস্তান বিরোধী অবস্থান নেওয়ায় এবার সত্যিই বিপাকে পড়েছে অনুপ্রবেশকারীরা। ঘুষ দিয়েও টিকে থাকা মুশকিল হচ্ছে তাদের।
দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে মোটা টাকা আয়ের উৎসটাই বন্ধ হতে চলেছে পাকিস্তানি মানব পাচার চক্রের। তাই নতুন ডেস্টিনেশনের সন্ধান শুরু হয়েছে। সোজা কথায়, দক্ষিণ আফ্রিকার বিকল্প খুঁজছে পাকিস্তান। মানবপাচারের নতুন দরোজা খুলতে হরেক পরিকল্পনা নিয়ে শুরু হয়েছে জল্পনা। এখন দেখার দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বিতারিত হয়ে কোন দেশকে টার্গেট করে ইসলামাবাদের সরকারি মদদপুষ্ট মানবপাচার চক্র।
আরও পড়ুন: