ঢাকা বুধবার, ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ 

সুফি ঐতিহ্য: ভারতের বহুত্ববাদের প্রতীক

ঢাকা এজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৭:০৯, ১৫ জানুয়ারি ২০২৫

শেয়ার

সুফি ঐতিহ্য: ভারতের বহুত্ববাদের প্রতীক

অনন্য সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের দেশ ভারত। যুগ যুগ ধরে এখানে অসংখ্য ধর্ম, ঐতিহ্য, এবং দর্শনের সমন্বয় ঘটে চলেছে। এই সমন্বয়ের অন্যতম প্রেরণা হলো সুফি ঐতিহ্য, যা আজও জাতির প্রাণকেন্দ্রে প্রতিধ্বনিত। প্রেম, সম্প্রীতি এবং সহনশীলতার বার্তাবাহক সুফিবাদ কেবল ধর্মের সীমানা অতিক্রম করেই না, বরং ভারতীয় আত্মার প্রতিচ্ছবি।

ইসলামের রহস্যবাদী ধারা সুফিবাদ আত্মশুদ্ধি, মানবতার ঐক্য এবং ঐশ্বরিক ভক্তির ওপর গুরুত্বারোপ করে। শতাব্দী আগে ভারতে আগত সুফি সাধকগণ বিভিন্ন সংস্কৃতি, সম্প্রদায় এবং ধর্মের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করেছিলেন। কবিতা, সঙ্গীত এবং জীবনাদর্শের মাধ্যমে তাঁদের উপদেশ শান্তি ও প্রেমের সর্বজনীন আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিফলিত করে, যা সমাজের সকল স্তরের মানুষ গ্রহণ করেছে।

খাজা মইনুদ্দিন চিশতী, যিনি 'গরীব নওয়াজ' নামে পরিচিত, এই ঐতিহ্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আজমীরে তার দরগাহ সকল শ্রেণির মানুষের আশার আলো। করুণা ও সেবার মূলনীতিতে প্রতিষ্ঠিত তার বাণী ভারতের সমন্বয়ের চেতনাকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে। তার দরগাহের লঙ্গরখানায় জাতি, ধর্ম, মর্যাদা নির্বিশেষে সকলকে খাবার পরিবেশন করা হয়, যা সাম্যের এক জীবন্ত প্রমাণ।

প্রধানমন্ত্রী মোদির চাদর প্রদান: ঐক্যের প্রতীক

ভারতে সুফি ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রতিবছর খাজা গরীব নওয়াজের মৃত্যুবার্ষিকী 'উরস' উপলক্ষে আজমীর শরীফ দরগাহে চাদর পাঠান। এই কর্ম সুফি সাধকের শিক্ষা এবং ধর্মীয় ও সামাজিক বিভাজন দূর করে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার ভূমিকার প্রতি সরকারের শ্রদ্ধার প্রকাশ।

আজমীর দরগাহ পরিদর্শনকালে কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী কিরণ রিজিজু বলেন, ‘আজমীর শরীফ দরগাহ কেবল একটি মাজার নয়; এটি ভারতের বহুত্ববাদী ও সমন্বয়ের চেতনার প্রতীক। প্রধানমন্ত্রীর চাদর প্রদান জাতি ও বিশ্বের জন্য সম্প্রীতি এবং ঐক্যের বার্তা।’

সুফি সাধকগণ জনসাধারণের ভাষায় কথা বলেছেন, স্থানীয় কবিতা ও সঙ্গীত ব্যবহার করেছেন। হযরত নিজামুদ্দিন ঔলিয়া এবং বাবা ফরিদ ধর্মীয় বিদ্বেষের ব্যর্থতা তুলে ধরে সর্বজনীন ভ্রাতৃত্বের বার্তা প্রচার করেছেন। ভারতের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা তাঁদের মাজারগুলি সাম্প্রদায়িক ও আধ্যাত্মিক সম্প্রীতির কেন্দ্রবিন্দু। কওয়ালি সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের প্রতীক।

বিভক্ত এই বিশ্বে, সুফিবাদের সমন্বয়ের চেতনা আমাদের মানুষ হিসেবে একত্রিত করার আহ্বান। সুফিবাদ ঐক্যবদ্ধ এবং নিরাময়ের চেষ্টা করে। এটি ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’-এর সঙ্গে মিলে যায়।

আধুনিক ভারতে এই ঐতিহ্যগুলিকে পরিপোষণ ও উদযাপন করা জরুরি। সুফি মাজারের ঐতিহ্য ও তাদের প্রেমের বার্তাকে সংরক্ষণ করা উচিত।

মাজার সংস্কার, সাংস্কৃতিক প্রকাশকে সমর্থন এবং আন্তঃধর্মীয় সংলাপ প্রচার করলে এই ঐতিহ্যগুলি উন্নতি লাভ করবে। শিক্ষা পাঠ্যক্রমে সুফি সাহিত্য প্রবর্তন করলে তরুণ প্রজন্ম এই মূল্যবোধের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারবে।

ভারতের সুফি ঐতিহ্য কেবল একটি আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য নয়; এটি একটি সমন্বয়কারী এবং সম্প্রীতিপূর্ণ ভবিষ্যতের দিশারী। প্রধানমন্ত্রীর চাদর প্রদান এবং সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী রিজিজুর বক্তব্য ভারতের সুফি ঐতিহ্যের প্রতি গভীর শ্রদ্ধার প্রমাণ। সুফিবাদ উদযাপনের মধ্য দিয়ে ভারত তার বহুত্ববাদী চেতনার শ্রেষ্ঠ রূপটি উদযাপন করে।

বিশ্বখ্যাত সুফি কবি রুমি বলেছিলেন, "ভুল এবং সঠিকের ধারণার বাইরে একটি ক্ষেত্র আছে। আমি তোমার সঙ্গে সেখানে দেখা করবো।" এই "ক্ষেত্র"টিই সুফিবাদের মূলকথা — আর এটিই ভারতের আত্মা। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে এই আত্মা সবসময় জীবন্ত ও স্পন্দনশীল থাকে, কারণ এটি শুধু ভারতের জন্য নয়, সমগ্র বিশ্বের জন্য একটি অমূল্য উপহার।

লেখক আজমীর শরীফ দরগাহের গদ্দিনশীন এবং চিশতী ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান।

novelonlite28
umchltd