ঢাকা শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ 

করোনার নতুন ধরন কতটা উদ্বেগের

রাশিদুল হক

প্রকাশিত: ২৩:৫৪, ১ সেপ্টেম্বর ২০২৩

শেয়ার

করোনার নতুন ধরন কতটা উদ্বেগের

চীনের উহান শহরে প্রথম ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে সার্স-কোভি-২ বা করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। তারপর থেকে ২০২১ সালের শেষ অবধি করোনার তাণ্ডব আমরা দেখেছি। আমরা অনেকেই এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছি। এই ভাইরাসের বিভিন্ন ধরনে বিশ্বব্যাপী মারা গেছেন প্রায় ৭০ লাখ মানুষ। সরকারি হিসাবমতে, বাংলাদেশে গতকাল বুধবার পর্যন্ত কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২৯ হাজার ৪৭৬ জন।

কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ ছিল সার্স-কোভি-২ ভাইরাসের দুটি ধরন—আলফা ও ডেলটার। এই দুই ভাইরাসের লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল ডেলটা। ভাইরাসের এই ধরনই ২০২১ সালে বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি ছিল। তখন বিশ্বব্যাপী করোনা সংক্রমণের শীর্ষে ছিল ডেলটা (রা. হক: যুগান্তর, আগস্ট ২৩, ২০২১)। করোনার এই ধরনে সংক্রমিত হয়েছিলেন বিশ্বের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ।
করোনার প্রাদুর্ভাবের পর সার্স-কোভি-২ ভাইরাসের অমিক্রন (প্যাঙ্গো বংশনাম বি.১.১.৫২৯) ধরনের বিস্তারের ফলে ২০২২ সালের প্রথম কয়েক মাস (জানুয়ারি থেকে মার্চ) বিশ্ব দেখেছিল কোভিড-১৯-এর সবচেয়ে বড় ঢেউ। ২০২১ সালের শেষের দিকে করোনার অমিক্রন ধরনের আবির্ভাব ঘটে। ২০২২ সালে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই প্রায় সাড়ে ৪ কোটি মানুষ সংক্রমিত হয়েছেন। মৃত্যু হয়েছে প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার মানুষের। তবে ইতিমধ্যে কোভিডের বিরুদ্ধে মানবদেহে যথেষ্ট প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে উঠেছে। এতে মানুষের জীবন অনেকটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। সর্বজনীন টিকা, ফলপ্রসূ অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ, কার্যকর মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি আবিষ্কারের ফলেই তা সম্ভব হয়েছে।
তবে এখনো উদ্বেগের বিষয়, করোনাভাইরাস পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে যায়নি। সম্মিলিত প্রাকৃতিক ও টিকার বদৌলতে ২০২২ সালের শেষের দিকে কোভিড-১৯ অনেকটাই কমে এলেও অস্ট্রেলিয়া, চীন, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশে গত নভেম্বরে আবার সংক্রমণ বাড়তে থাকে। সেই ধারাবাহিতা ২০২৩ সালকেও স্পর্শ করেছে।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম থেকে জানা যাচ্ছে, করোনার অমিক্রন ধরনের বিভিন্ন উপধরনের দাপটে চলতি বছরের ২৭ আগস্ট পর্যন্ত শুধু যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৫৩ হাজার মানুষ মারা গেছেন। বিশ্বব্যাপী মাত্র ২৮ দিনে (গত ৩ থেকে ৩০ জুলাই) ১০ লাখের বেশি মানুষ নতুন করে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়েছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য বলছে, এ সময়ে মারা গেছেন প্রায় ৩ হাজার ১০০ জন।
সফল টিকা আবিষ্কার এবং উন্নত সামাজিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে করোনা-সংক্রমণ কমেছে বটে; কিন্তু মানুষের মধ্যে টিকার প্রয়োগের পরও মূল অমিক্রন (বি.১.১.৫২৯) বেশ কয়েকটি সংক্রমণশীল উপধরনের জন্ম দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বিএ.১, বিএ.২, বিএ.৩, বিএ.৪ এবং বিএ.৫। বিএ.২ বা ‘স্টিলথ ধরন’ নামে পরিচিত অমিক্রনের এই উপধরনের ক্রমবর্ধমান সংক্রমণ বেশ উদ্বেগ তৈরি করেছিল। কারণ, বিএ.২ অমিক্রন উপধরনটি বিএ.১ উপধরনের চেয়ে ১ দশমিক ৫ গুণ বেশি সংক্রমণযোগ্য ছিল (রা. হক: যুগান্তর, ৬ ডিসেম্বর, ২০২১)।

গত বছরের অক্টোবর থেকে অমিক্রনের বেশ কিছু নতুন সংস্করণ যেমন-বিএ.৫-উদ্ভূত বিকিউ.১ এবং বিকিউ.১.১, এবং এক্সবিবির প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এসব নতুন ধরন ২০২২ সালের শেষের তিন মাস (অক্টোবর-ডিসেম্বর) সারা বিশ্বে ডেলটা সংক্রমণকে ছাড়িয়ে যায়।
এ বছর করোনার নতুন ধরন
সার্স-কোভি-২ ভাইরাস জন্মলগ্ন থেকে আজ অবধি সময়ের ব্যবধানে মিউটেশনের (জিন পরিব্যক্তি) মাধ্যমে বারবার রূপ বদলেছে। চলতি বছরের প্রথম দিকে আবির্ভূত এক্সবিবি ধরনগুলোর সংক্রমণ আমরা দেখেছি, যা ধীরে ধীরে বেশ প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে। এগুলো জন্ম দেয় উচ্চ সংক্রমণশীল নতুন একটি উপধরনের। নতুন ধরন ইজি.৫ অমিক্রন-উদ্ভূত এক্সবিবি স্ট্রেনের একটি প্রাণঘাতী উত্তরসূরি। এ ছাড়া বিএ.২ এবং এক্সবিবি গোত্রীয় আরেকটি করে সংক্রমণশীল উপধরন বিএ.২.৮৬ এবং এফএল.১.৫.১-এর উদ্ভব হয়েছে।
২০২৩ সালের শুরুতে অমিক্রনের উপধরন এক্সবিবি.১.৫ (যাকে তুলনা করা হয়েছে কিংবদন্তি ক্র্যাকেন বা সমুদ্র দানবের সঙ্গে) দ্রুত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় এটাই ছিল সবচেয়ে সংক্রমণযোগ্য অমিক্রন ধরন। এই উপধরনের স্পাইক প্রোটিনে রয়েছে এফ৪৮৬পি মিউটেশন, যা সংক্রমণ ক্ষমতা আরও বাড়িয়ে তোলে।

অতি সংক্রমণশীল ইজি.৫ উপধরনকে তুলনা করা হয়েছে দ্বন্দ্ব ও বিরোধের গ্রিক দেবী ‘এরিস’-এর সঙ্গে। ইতিমধ্যে এরিসের প্রকোপ ছড়িয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ প্রায় ৩৮টি দেশে। গত এক মাসে (৩ আগস্ট পর্যন্ত) বিশ্বব্যাপী ১০ লাখের বেশি মানুষ এরিস ধরনে আক্রান্ত হয়েছেন। এতে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৩ হাজার ১০০ মানুষের। তাই বিশ্বজুড়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিওইচও)। জিনগতভাবে ইজি.৫ খুব দ্রুত সংক্রমণশীল হয়ে উঠছে। এরই মধ্যে এর একটি অনুরূপও তৈরি হয়েছে ইজি.৫.১।
‘স্পাইক’ প্রোটিনের বৈশিষ্ট্য
এর আগে করোনাভাইরাস নিয়ে আমার বিভিন্ন লেখায় স্পাইক প্রোটিনের ব্যাপারে বিশদ ব্যাখ্যা করেছি। তারপরও প্রোটিনটির বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে এখানে সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। করোনাভাইরাস (সার্স-কোভি-২) তার ‘আরএনএ জিনোম’-এর জিনগত কোড অনুযায়ী সর্বসাকল্যে ৩০-৩২টি প্রোটিন তৈরি করতে সক্ষম। এর মধ্যে চারটি প্রধান কাঠামো প্রোটিন হচ্ছে স্পাইক (এস) গ্লাইকোপ্রোটিন, এনভেলপ (ই) প্রোটিন, মেমব্রেন (এম) প্রোটিন এবং নিউক্লিওক্যাপসিড (এন) প্রোটিন।
স্পাইক প্রোটিনের আবার দুটি সাব-ইউনিট রয়েছে—এস১ ও এস২। মানব কোষে এই ভাইরাসের প্রবেশ স্পাইক প্রোটিনের (এস১ সাব-ইউনিট) মধ্যস্থতা করা হয়, যা মানব কোষঝিল্লিতে অবস্থিত ‘অ্যাঞ্জিওটেনসিন-রূপান্তরিত এনজাইম-২’ রিসেপ্টরের সঙ্গে আবদ্ধ হওয়ার জন্য দায়ী এবং ভাইরাস ও কোষীয় মেমব্রেন একীভূতকরণের জন্য দায়ী স্পাইক প্রোটিনের এস২ সাব-ইউনিট। মানব কোষের অভ্যন্তরে প্রবেশের পর কোষের প্রোটিন-সংশ্লেষণকারী উপাদান ব্যবহার করে ভাইরাসগুলো তাদের অসংখ্য প্রতিলিপি তৈরি করে, যা আমাদের ফুসফুসসহ দেহের অন্যান্য অঙ্গকে অকার্যকর করে দেয়।
এসিই-২-এর সঙ্গে এই বন্ধন বাধ্যবাধকতাপূর্ণ বলেই আমাদের দেহে যেসব অঙ্গে বা কোষে এসিই-২ প্রোটিন বিদ্যমান নয়, সেসব কোষের ভেতর করোনাভাইরাস প্রবেশের কোনো সুযোগ থাকে না। সংক্রমণশীল স্পাইক প্রোটিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটুকু হলো ‘রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেইন’ (আরবিডি), অর্থাৎ পুরো স্পাইক প্রোটিনের পরিবর্তে কেবল ‘আরবিডি’ (অ্যামিনো অ্যাসিড ৩৩৮-৫৩০) এসিই-২ রিসেপ্টর প্রোটিনের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে পুরো ভাইরাসকে কোষের অভ্যন্তরে ঢোকার সুযোগ করে দেয়। রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেইন ১৯২টি অ্যামিনো অ্যাসিড নিয়ে গঠিত।
ইজি.৫ উপধরন অতিমাত্রায় সংক্রমণশীল হওয়ার কারণ
ইজি.৫ প্রথম শনাক্ত হয়েছে চলতি বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি। এটি হচ্ছে এক্সবিবি.১.৯.২-এর একটি বংশধর, যার এক্সবিবি.১.৫.-এর মতো একই স্পাইক প্রোটিনের অ্যামিনো অ্যাসিড প্রোফাইল রয়েছে। অমিক্রন এক্সবিবি ধরনগুলোতে আমরা দেখেছি নানা ধরনের মিউটেশন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে এস:৪৮৬পি, এস:৪৫৬এল এবং এস:৪৭৮আর, যা সহজেই দেহের ইমিউন সিস্টেমের প্রতিরোধক্ষমতাকে এড়িয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া এসব মিউটেশন তাদের বংশবৃদ্ধির সুবিধাও দিয়ে থাকে।

এর বাইরে পূর্বসূরি এক্সবিবি.১.২.৯ এবং এক্সবিবি.১.৫-এর তুলনায় ইজি.৫ ও এফএল.১.৫.১ স্পাইক প্রোটিনটির আরবিডি অঞ্চলে অতিরিক্ত একটি মিউটেশন (এস:৪৫৬এল) বহন করে, যেখানে ফেনিল্যালানিনের (এফ:পিএইচই) পরিবর্তে প্রতিস্থাপিত হয়েছে লিউসিন (এল:লিউ) অ্যামিনো অ্যাসিড, যা মানব এসিই-২ রিসেপ্টরের সঙ্গে শক্ত বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এই মিউটেশন সম্ভবত ভাইরাসকে দেহের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থাকেও এড়াতে সাহায্য করে।
এ ছাড়া ইজি.৫-এর নব্য সংস্করণ ইজি.৫.১ স্ট্রেনে রয়েছে আরও একটি নতুন স্পাইক মিউটেশন এস:কিউ৫২এইচ (গ্লুটামেটের পরিবর্তে হিস্টিডিনের প্রতিস্থাপন), যা এই স্ট্রেনের সংক্রমণ ক্ষমতা আরও বাড়িয়েছে। ইজি.৫ ভারতেও গত মে-জুনে শনাক্ত হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার মতো ভারতে মোট সংক্রমণের ৯০ থেকে ৯২ শতাংশ অমিক্রন ধরন এক্সবিবির বিভিন্ন উপধরনে সংক্রমিত হচ্ছে। অন্যদিকে বিএ.২.৮৬-এর স্পাইক প্রোটিনে যেসব মিউটেশন দেখা গেছে, তা আদি অমিক্রন বিএ.১ উপধরনের মতো।

অধ্যাপক রাশিদুল হক সাবেক সহ-উপাচার্য, বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়

novelonlite28
umchltd