ঢাকা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে উত্তরের ঈদযাত্রায় এবারও ভোগান্তির শঙ্কা রয়েছে। মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজে ধীরগতি এবং ওভারপাস–আন্ডারপাস নির্মাণকাজের কারণে ঈদের আগের দিনগুলোতে বড় ধরনের যানজটের আশঙ্কা করা হচ্ছে। সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল থেকে রংপুর পর্যন্ত অন্তত ৩৫টি স্থান এবং বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব প্রান্তের সংযোগ সড়কের প্রায় আট কিলোমিটার দুর্ভাবনা কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ঢাকা-রংপুর মহাসড়কে সাধারণ সময়ে দিনে ২০ হাজারের মতো যানবাহন চলাচল করে। ঈদ ঘিরে এ সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। ফলে বাড়তি গাড়ির চাপের পাশাপাশি সড়ক উন্নয়নকাজের ধীরগতির কারণে পুরোনো ভোগান্তির আশঙ্কা থাকছেই।
ভোগান্তি নিরসনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো যানজটপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করে কাজ করছে। ঈদের আগে একটি ওভারপাস খুলে দেওয়া, কিছু সংস্কারকাজ শেষ করা এবং প্রয়োজনে এলেঙ্গা থেকে উত্তরবঙ্গগামী সড়ক একমুখী করে দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার প্রস্তুতির কথা জানিয়েছে তারা।
হাটিকুমরুল–রংপুর ৩৫টি স্থান চিহ্নিত
চার লেন নির্মাণকাজের কারণে মহাসড়কের সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল থেকে রংপুর পর্যন্ত অন্তত ৩৫টি স্থানে ঈদযাত্রায় ভোগান্তির শঙ্কা করছে যানজট নিরসনে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। ভোগান্তির শঙ্কা রয়েছে চান্দাইকোনা থেকে চাপড়িগঞ্জ পর্যন্ত বগুড়ার ৬৬ কিলোমিটারের বেশ কিছু অংশে।
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে ২১ মার্চ অনুষ্ঠিত ‘নিরাপদ ও নির্বিঘ্নে ঈদযাত্রায় করণীয়’ শীর্ষক এক সভায় এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়কের অন্তত ৩৫টি স্থানে ভোগান্তির শঙ্কার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। একই সঙ্গে ওই বৈঠক থেকে ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে তিন দফা সুপারিশ করা হয়েছে। সুপারিশের মধ্যে আছে মহাসড়ক ও সেতু সংস্কার, ইলেকট্রনিক টোল আদায় ব্যবস্থা চালু এবং মহাসড়কের বিভাজক সংস্কার ও মেরামত।
চালক ও যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মহাসড়ক সম্প্রসারণ কাজ ছাড়াও আন্ডারপাস ও ওভারপাস নির্মাণের কারণে ধীরগতিতে যানবাহন পারাপার হচ্ছে। এতে মহাসড়কে থেমে থেমে যানজট তৈরি হচ্ছে। ঈদের আগে মহাসড়কে যানবাহনের চাপ আরও কয়েক গুণ বেড়ে গেলে যানজটপ্রবণ স্থানে ভোগান্তি বাড়বে।
গতকাল সোমবার ও এর আগের দুই দিন এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়কের সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল গোলচত্বর থেকে গাইবান্ধার পলাশবাড়ী অংশ পর্যন্ত ঘুরে অন্তত ২৫টি স্থানে মহাসড়ক সম্প্রসারণ এবং ওভারপাস ও আন্ডারপাস নির্মাণের কারণে ধীরগতিতে এক লেনে যানবাহন চলাচল করতে দেখা গেছে।
যানজটপ্রবণ এসব স্থানের মধ্যে রয়েছে সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল বাজার, ঘুরকা বেলতলা, ভূঁইয়াগাতী, হাইওয়ে অভি ভিলা, সীমাবাড়ি, ফুড ভিলেজ ও পেন্টাগন হোটেলের সামনের এলাকা, চান্দাইকোনা বাজার, ঘোগা বটতলা; বগুড়ার ছনকা বাজার, শেরপুর সদর, নয়মাইল, মাঝিড়া, বনানী বাসস্ট্যান্ড, ফুলতলা, শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের সামনের এলাকা, তিনমাথা রেলগেট, চারমাথা বাস টার্মিনালের সামনের এলাকা, বারপুর মোড়, মাটিডালী মোড়, ঠেঙ্গামারা, মহাস্থান ও মোকামতলা উড়ালসড়কের নিচের অংশ; গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ শহরের অংশ এবং পলাশবাড়ী শহরের অংশ।
গতকাল সরেজমিন দেখা যায়, চার লেন সম্প্রসারণ কাজের কারণে বগুড়া শহরের তিনমাথা রেলগেটে রেলওয়ে ওভারপাস এলাকায় থেমে থেমে যানজট হচ্ছে। ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে চালক ও যাত্রীদের। বগুড়ার মাটিডালী বিমানমোড় এলাকায় লেন সম্প্রসারণ কাজের কারণে এক লেনে যানবাহন চলাচল করছে। এতে থেমে থেমে যানজট তৈরি হচ্ছে।
মহাসড়ক সম্প্রসারণ কাজের কারণে এক লেনে গাড়ি চলাচল করায় যানজট দেখা গেছে বগুড়া সদরের টিএমএসএসের প্রধান কার্যালয় এলাকায়ও। মহাসড়কে থেমে থেমে যানজট ছিল মহাস্থান ও মোকামতলা আন্ডারপাস এলাকায়ও।
ঈদ সামনে রেখে যানবাহনের চাপ বেড়ে গেলে এসব এলাকায় ভোগান্তির শঙ্কা প্রকাশ করেছেন চালকেরা। ঢাকা-পঞ্চগড় রুটের বাসচালক জাহান আলী বলেন, রংপুরের পীরগঞ্জ বিশমাইল আন্ডারপাস, পীরগঞ্জের বড়দরগাহ আন্ডারপাস, শঠিবাড়ী আন্ডারপাস, মিঠাপুকুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় এক লেনে ধীরগতিতে যানবাহন পার হচ্ছে। গাড়ির চাপ বেড়ে গেলে এসব স্থানে যানজটও বাড়বে।
একই আশঙ্কা করছেন রংপুরগামী দূরপাল্লার বাসের চালক উজ্জ্বল হোসেনও। তিনি বলেন, ঈদযাত্রায় এবার সিরাজগঞ্জ থেকে রংপুর পর্যন্ত পুরোটাতেই ভোগান্তির শঙ্কা রয়েছে। বগুড়ার তিনমাথা ওভারপাস খুলে না দেওয়ায় থেমে থেমে যানজট লেগেই আছে। সবচেয়ে বড় শঙ্কা তৈরি হয়েছে বগুড়ার মাটিডালী ও ঠেঙ্গামারা এলাকায়।
জানতে চাইলে হাইওয়ে পুলিশ বগুড়া অঞ্চলের পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান বলেন, ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়কে ৪২টি ঝুঁকিপূর্ণ স্থান চিহ্নিত করে ‘সাউথ এশিয়া সাব-রিজিওনাল ইকোনমিক কো-অপারেশন (সাসেক)-২’ প্রকল্প এবং সওজের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছিল। সুপারিশ অনুযায়ী, ইতিমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ বেশির ভাগ স্থান সংস্কার করেছে সাসেক।
হাবিবুর রহমান বলেন, এখন ছয়-সাতটি স্থানে যানজটের শঙ্কা থাকলেও ঈদের আগে সমস্যার সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সাসেক-২ ও সওজ কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করা হয়েছে। এ ছাড়া মহাসড়কে অযান্ত্রিক যানবাহন নিয়ন্ত্রণ, বিকল বাস রেকার দিয়ে টেনে দ্রুত সরিয়ে নেওয়ার সব রকমের প্রস্তুতি হয়েছে।
সাসেক-২ প্রকল্পে ধীরগতি
সাসেক-২ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালে। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এখন পর্যন্ত কাজের কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি নেই। সরেজমিন দেখা যায়, বগুড়ার তিনমাথা রেলগেট এলাকায় ওভারপাস নির্মাণের কাজ শেষের দিকে। মাটিডালী উড়ালসেতু নির্মাণের উদ্যোগ আপাতত বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ, গাইবান্ধার পলাশবাড়ীসহ তিনটি স্থানে ফ্লাইওভার নির্মাণকাজ শুরুই হয়নি। বগুড়ার জাহাঙ্গীরাবাদ সেনানিবাসের সামনে আন্ডারপাসের নির্মাণকাজ শেষ হলেও খুলে দেওয়া হয়নি।
জানতে চাইলে সাসেক-২ প্রকল্প পরিচালক ওয়ালিউর রহমান গত রোববার বলেন, ঢাকা-রংপুর মহাসড়কে ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে বগুড়ার তিনমাথা রেলওয়ে ওভারপাস খুলে দেওয়া ছাড়াও বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কাজে ধীরগতির কথা নাকচ করে তিনি বলেন, এ বছরের ডিসেম্বরে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে।
দুর্ভাবনায় আট কিলোমিটার
এবারের ঈদযাত্রায় ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কের সেতুর পূর্ব প্রান্তের সংযোগ সড়কের প্রায় আট কিলোমিটারে যানজটের জন্য দুর্ভাবনা কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই মহাসড়কের টাঙ্গাইল জেলার অংশের মধ্যে পড়েছে ৬৫ কিলোমিটার। ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা যানবাহন চার লেনের সুবিধায় কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গা পর্যন্ত আসতে পারে। এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর চার লেন প্রকল্পের আওতায় সেতুর পূর্ব প্রান্তের সংযোগ সড়কের এলেঙ্গা থেকে সেতুর দিকে আড়াই কিলোমিটার চার লেন সড়ক নির্মাণ হয়েছে।
অপর দিকে সেতুর পূর্ব প্রান্তের গোলচত্বর থেকে জোকারচর পর্যন্ত তিন কিলোমিটার সড়ক চার লেন হয়েছে। মাঝে প্রায় আট কিলোমিটার রয়ে গেছে দুই লেনের সড়ক। আর এই আট কিলোমিটারে যানজটের আশঙ্কা করছেন পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
গতকাল মহাসড়কের মির্জাপুর থেকে এলেঙ্গা পর্যন্ত সরেজমিনে দেখা যায়, ওই আট কিলোমিটার অংশের কোথাও মাটি ফেলার কাজ হচ্ছে, আবার কোথাও সেতু, কালভার্ট নির্মাণকাজ চলছে। এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় রাস্তার পাশে বৈদ্যুতিক খুঁটি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। সেখানে সড়ক সম্প্রসারণের কাজ চলছে।
টাঙ্গাইলের ট্রাফিক পরিদর্শক (টিআই) রফিকুল ইসলাম সরকার জানান, যানবাহনের চাপ বেশি হলে এলেঙ্গা থেকে উত্তরবঙ্গগামী সড়ক একমুখী (ওয়ানওয়ে) করে দেওয়া হবে। তখন উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকাগামী যানবাহন সেতু পার হওয়ার পর ভূঞাপুর হয়ে এলেঙ্গা পর্যন্ত চলাচলের ব্যবস্থা করা হবে। এ জন্য সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন: